মো.রকিবুল হাসান বিশ্বাস,সিংগাইর(মানিকগঞ্জ)প্রতিনিধি: মানিকগঞ্জের সিংগাইরে দীর্ঘ ২১ বছর পর স্ত্রীকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার চাঞ্চল্যকর মামলার মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি মোঃ আলমকে (৪০) গ্রেফতার করেছে র‍্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-৪ (র‍্যাব-৪)। গ্রেফতারকৃত আলম উপজেলার চান্দহর ইউনিয়নের আটিপাড়া গ্রামের মোঃ রইস উদ্দিনের ছেলে। চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে সে সবার বড়। হত‍্যার শিকার আম্বিয়া (১৮) একই গ্রামের মোঃ মকবুল হোসেনের মেয়ে।

রবিবার (১৪ আগস্ট) র‍্যাব-৪ এর এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানা যায়, স্ত্রী আম্বিয়াকে (১৮) পেট্রোল ঢেলে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে দীর্ঘ ২১ বছর আত্মগোপনে ছিল আসামি আলম। অবশেষে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র‍্যাবের একটি আভিযানিক দল গতকাল শনিবার (১৩ আগস্ট) দিবাগত রাতে রাজধানীর বংশাল এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে।

র‍্যাব জানায়, গ্রেফতারকৃত মোঃ আলম ও নিহত আম্বিয়া একই গ্রামের বাসিন্দা। ঘটনার তিন মাস পূর্বে ২০০১ সালের জুন মাসে পারিবারিকভাবে তাদের বিয়ে হয়। বিয়ের সময় আম্বিয়ার বাবা সামথর্য অনুযায়ী আসবাবপত্র, ইলেক্ট্রনিকস সামগ্রী, নগদ অর্থ ও স্বর্ণালংকার প্রদান করে। অত্যান্ত লোভী ও বদমেজাজী আলম আরও অধিক যৌতুকের দাবিতে প্রায়ই তার স্ত্রী আম্বিয়াকে মারধর করত। একপর্যায়ে আলম ও তার বাবা-মা ও নিকট আত্মীয়-স্বজন আম্বিয়ার পরিবারের নিকট আরো ৫০ হাজার টাকা যৌতুক দাবি করে।আম্বিয়ার দরিদ্র পিতা এর মধ্যে ধার দেনা করে আলমকে ১০ হাজার টাকা প্রদান করে। অবশিষ্ট ৪০ হাজার টাকা দিতে না পারায় আম্বিয়ার ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দেয় পাষন্ড স্বামী। ঘটনার ১০-১২ দিন পূর্বে স্ত্রী আম্বিয়াকে বাড়িতে না উঠানো ও হত‍্যার হুমকি দিয়ে মারধর করে অবশিষ্ট টাকা আনার জন্য বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৫ তারিখ দিবাগত রাত সাড়ে ১১ টার দিকে আলম শশুর বাড়ি গিয়ে স্ত্রীকে ঘরের বাইরে ডেকে নিয়ে যায়। বাড়ির ৩০০ গজ দূরে ফাঁকা রাস্তার ওপর চর, থাপ্পর, কিল, ঘুষি মেরে আহত করলে আম্বিয়া মাটিতে লুটিয়ে পরে। এরপর পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সংগ্রহে রাখা পেট্রোল স্ত্রীর গায়ে ঢেলে দিয়াশলাই দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। ভিকটিমের চিৎকার এবং আর্তনাদে ভিকটিমের মা-বাবা ও আত্মীয়-স্বজনসহ আশপাশের প্রতিবেশীরা এসে আগুন নিভায় এবং গুরুতর অগ্নিদগ্ধ আম্বিয়াকে প্রথমে সিংগাইরের সেবা ক্লিনিক ও পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর ৬ সেপ্টেম্বর চিকিৎসাধীন অবস্থায় সকাল ৮টার দিকে আম্বিয়ার মৃত্যু হয়। পরবর্তীতে রমনা থানা পুলিশ হাসপাতালে উপস্থিত হয়ে মৃতদেহের সূরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুত করে এবং ওই হাসপাতালেই মৃতদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেন।

এরপর ২০০১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর আম্বিয়ার বাবা মোঃ মকবুল হোসেন সিংগাইর থানায় আলম ও তার বাবা মোঃ রহিজ উদ্দিন, মা আলেয়া বেগম, আলমের বোন জামাই রবিউল, আলমের চাচাতো নানা আফতাবসহ ৫ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
মামলার পর হতে আসামী আত্মগোপনে থাকায় থানা পুলিশ মূল আসামী আলমকে গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হয়। মামলার তদন্ত শেষে তদন্তকারী কর্মকর্তা আসামী আলমের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট প্রদান করেন এবং বাকি ৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় চার্জশীট থেকে অব্যহতির দেন। পরবর্তীতে মানিকগঞ্জ জেলার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন স্পেশাল ট্র্যাইবুনাল এর বিজ্ঞ বিচারক ভিকটিম আম্বিয়াকে হত্যাকান্ডে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার অপরাধে ২০০৩ সালের ৩০ নভেম্বর চার্জশিটে অভিযুক্ত আসামী আলমকে মৃত্যুদন্ড সাজা প্রদান করেন। পরবর্তীতে ডেথ রেফারেন্সের জন্য মামলা উচ্চ আদালতে গেলে সেখানেও ২০০৬ সালের ৬ জুলাই আসামী আলম এর মৃত্যুদন্ড বহাল রেখে রায় প্রদান করে।

গত ২১ বছর ধরে আসামী আলম এনআইডিতে নিজের নাম ঠিক রেখে বাবা-মায়ের নাম ও ঠিকানা পরিবর্তন করে বিভিন্ন ছদ্মবেশ ধারণ করে পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় আত্মগোপনে ছিল। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় আসামী নিজের পরিচয় গোপন করার জন্য ক্রমাগতভাবে সে পেশা পরিবর্তন করে আসছিলো। প্রথমদিকে সে পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় শ্রমিকের কাজ করতো। পরবর্তীতে সে বাসা ভাড়ার দালালি করে জীবিকা নির্বাহ করতো। গত কিছুদিন যাবৎ সে বংশালে একটি জুতার কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করে আসছিলো।

প্রথম স্ত্রী আম্বিয়াকে বিয়ের ৩ মাসের মধ্যে আগুনে পুড়িয়ে নৃশংস ভাবে হত্যার ৫ বছর পর পুনরায় ঢাকার বংশাল এলাকায় নিজের নাম ঠিকানা গোপন করে সূমী (৩৫) নামের অপর এক মেয়েকে বিয়ে করে ঢাকার টিকাটুলি এলাকায় বসবাস করে আসছিলো। দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরে তার মহিন (১৫) নামের একটি পুত্র সন্তান রয়েছে। ২০০১ সালের পর থেকে আলম আর কোনোদিন নিজ এলাকা সিংগাইরে আসেনি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *